মহামারী পবর্তী বাংলারদেশের অর্থনৈতিক খাতগুলোর চ্যালেঞ্জসমূহ


করোনা মহামারি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।জিডিপি হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করলেও এটি ২ এর ঘরে নেমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।তাই চ্যালেঞ্জমুখী খাতগুলো চিহ্নিত করা একান্ত জরুরি।
 পোশাক শিল্পঃ করোনা মহামারির কারনে বিশ্ববাজারে পোষাক রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে।বছরের উৎপাদনের মাঝামাঝি সময়ে ২৫ হাজার কোটি টাকার ক্রয় আদেশ বাতিল করেছে বিদেশী বায়াররা।নতুন করে তেমন অর্ডার পাওয়া যাচ্ছে না।অধিকাংশ শিল্প কাঁচামাল আসে বহির্বিশ্ব থেকে,যেগুলোর টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে গার্মেন্টস গুলো দেওলিয়া প্রায়। এদিকে পোশাক শিল্পে অধিকাংশ জনশক্তি কর্মরত,তাই চাকুরি হারানোর শঙ্কা সবার মাঝে বিরাজমান।  কৃষি ক্ষেত্রঃ জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ।করোনা ভাইরাস এবং সাম্প্রতিক বন্যার প্রাদুর্ভাবের শুরুর দেড় মাসেই কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির পরিমান ৫৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি।লকডাউনে পন্য বিপনন ব্যবস্থা ভেঙে পড়া,বাজারজাতকরণে বিড়ম্বনা, ন্যায্যমূল্য না পাওয়ারসহ নানা সংকটে পতিত হওয়ায় করোনা পরবর্তী অর্থনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে কৃষি খাত।
 ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পঃ বাংলাদেশের জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ২০ থেকে ২৫ ভাগ।বর্তমানে দেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান ক্ষুদ্রও মাঝারি শিল্পখাতে।কিন্তু বর্তমান বাজারে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ছাড়া অন্যান্য পন্যের তেমন চাহিদা না থাকায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী স্টকে জমা হয়ে আছে।এর ফলে ইতোমধ্যেই একাংশ উদ্যোক্তা দেওলিয়া প্রায়এবং কর্মজীবীরা প্রতিনিয়ত চাকুরি হারাচ্ছে।
 সেবা খাতঃ সদ্য সমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান ১৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ।কিন্তু করোনা মহামারিতে সেবা খাতের কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে।প্রায় সব ধরনের পর্যটন,বিনোদন,রিয়েল স্টেট,যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে আছে।বন্দরগুলো ঠিকভাবে মালামাল খালাস করতে পারছেনা।প্রতিদিন সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমান প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।যা সামনে অর্থনীতিকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করবে।  রেমিট্যান্সঃ করোনার মহামারির মধ্যেও অর্থনীতির জন্য সুখবর প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি ৩৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।তবে অধিক রিজার্ভের কারন প্রবাসীরা ভিসার মেয়ার উত্তীর্ণ হওয়ার শঙ্কায় জমাকৃত টাকা পাঠাচ্ছে ।ইতোমধ্যে ১৪ লক্ষ প্রবাসী কর্মহীন হয়ে আছে প্রবাসে এবং সংকট আরো বাড়বে।প্রবাসিদের নতুন কর্মসংস্থান এবং কর্ম নিশ্চিত করা নিয়ে তৈরি হতে পারে অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
 বেকারত্ব ও চাকুরী হারানোর শঙ্কাঃ বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকার সরকারী হিসেবে ২৬ লক্ষ ৭৭ হাজার এবং করোনাকালীন অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে চাকরি হারাতে যাচ্ছেন অন্তত দেড় কোটি কর্মজীবী মানুষ আর এতে ক্ষতির মুখে পড়বেন প্রায় ৬ কোটি মানুষ।করোনা পরবর্তীতে এদের কর্মসংস্থান করে দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

 অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ থেকে পরিত্রাণের উপায়? সমগ্র বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বাংলাদেশও এড়াতে পারবে না।তবে সময় উপযোগী পরিকল্পনা বাংলাদেশকে রিকোভার করতে সহায়ক ভুমিকা রাখতে পারে।
 অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে পদক্ষেপসমূহঃ • করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় সরকারকে দৃঢ় মনোবল এবং কাজে সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। • আপ্যায়ন,যাতায়াত এবং ভ্রমনের ক্ষেত্রে বাজেট কমিয়ে আনতে হবে। সাময়িক সময়ের এ পদক্ষেপে কয়েক কোটি টাকা বাঁচাবে।
• পূর্বে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধ রেপুটেশন ভালো,তাই আশা করা যায় পর্যাপ্ত ঋণ সুবিধা পাওয়া যাবে।আইএমএফের সুদমুক্ত ৭৬০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে,বিশ্বব্যাংকের কাছে ৫০০ মিলিয়ন এবং এডিবির কাছে ৫০০ মিলিয়ন সহায়তা চাওয়া হয়েছে।এছাড়াও বাংলাদেশকে চক্রাকার অর্থনীতিতে সহায়তা করবে নেদারল্যান্ডস এবং চীনা ব্যাংক ৫৭০০০ কোটি ডলার ঋণ দিতে সম্মতি দিয়েছে। • সরকার তার অর্থনৈতিক পুঁজি বৃদ্ধি করার স্বার্থে প্রগতিশীল কর আনয়ন করতে পারে।
• নিদ্রিষ্ট শর্ত ও শতাংশের উপর ভিত্তি করে সাময়িক সময়ের জন্য কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া হাতে নিতে পারে ।
 পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পে পদক্ষেপ সমূহঃ
• পোশাকসহ বিভিন্ন পন্যের বিশ্বেবাজারে ব্রান্ডিংয়ের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে হবে। • জরুরী ভিত্তিতে চট্রগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। • সাম্প্রতিককালে চীনের দেওয়া ৯৭% পন্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুযোগ গ্রহন এবং চাহিদা অনুযায়ী রপ্তানি বৃদ্ধি করতে হবে।
• করোনার ছড়ানোর অভিযোগে ইউরোপের অধিকাংশ রাষ্ট্র চীনের সাথে বানিজ্যিক সম্পর্ক রাখছে না।তাই বাংলাদেশ এসব দেশের সঙ্গে কুটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে পারলে পোশাকসহ অন্যান্য পন্যে রপ্তানীর নতুন দ্বার উম্মোচিত হতে পারে।
• বাংলাদেশের ওষুধ বিশ্ববাজারে সমাদৃত।ওষুধ শিল্প ও স্বাস্থ্য বিষয়ক(পিপিআই,স্যানিটাইজার ইত্যাদি) পণ্যসামগ্রী উৎপাদন বৃদ্ধি এবং চাহিদা অনুযায়ী রপ্তানির বৃদ্ধি করতে হবে।
• ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে সচল করার জন্য প্রনোদনা এবং সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
 কৃষি কাজে পদক্ষেপ সমূহঃ • স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় কৃষি পণ্যের পরিবহন, গুদামজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ কাজসমূহ সুচারুরূপে করা যায় সে ব্যবস্থা করা। • প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ,বীজ,সার,বালাইনাশক, সেচ ব্যবস্থাপনাসহ আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি সঠিক সময়ে প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। • কৃষি উপকরণ বাইরে থেকে আনা,খাদ্যপন্য আমদানী রপ্তানি, কৃষি পন্যে এবং উপকরণ অভ্যন্তরীন বাজার ব্যবস্থাপনা সুচারুরুপে চালু করতে হবে। • প্রচলিত কম উৎপাদনমূখী শস্য বীজের পরিবর্তে উচ্চফলনশীল বীজ কৃষকের হাতে তুলে দিতে হবে্। • কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ, প্রনোদনা বৃদ্ধিকরণ এবং তরুন প্রজন্মকে কৃষি কাজে আকৃষ্ট করার নিমিত্তে কম সুদে(৪%) ঋণ প্রদানের পরিকল্পনা হাতে নিতে পারে। • কৃষিপন্য সরাসরি ভোক্তাদের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য কৃষকদের বাজারজাতকরণে সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে
 রেমিট্যান্স ও প্রবাসীদের ব্যাপারে পদক্ষেপসমূহঃ
• রেমিট্যান্স ও প্রবাসীদের ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্রনালয়ের কার্যাবলী আরো বেগবান হতে হবে।ইউরোপিয়ান দেশগুলো করোনায় বেশি আক্রান্ত হওয়ার কারনে সে সকল দেশে প্রবাসীরা কর্মশূন্য হয়ে পড়েছে,সেক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যে তুলনামূলক ভাবে কিছুটা স্বাভাবিক আছে।সে সব দেশের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে জনশক্তি রপ্তানি করা সম্ভব।
• ২০২০ সালের বিশ্ব নার্সিং রিপোর্ট অনুযায়ী, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিশ্বব্যাপী আরো ছয় মিলিয়নের বেশি প্রশিক্ষিত নার্স প্রয়োজন
• প্রবাসীদের এক্সিট রি এন্ট্রি ভিশা প্রসেসের ব্যাপারে বিদেশী রাস্ট্রগুলোর সাথে সার্বিক যোগাযোগ ও বাস্তবায়নে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
• বিশ্ব বাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণবৃদ্ধি করতে হবে।
• করোনা পরবর্তীতে বিশ্বশ্রমবাজারে স্বাস্থ্য খাতে দক্ষ কর্মীদের চাহিদা বাড়বে। এ ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে আরো গতিশীল ও সক্ষম করার লক্ষ্যে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
• ‘ওয়েজ আর্নারস বন্ড’ চালুর মাধ্যমে সরকারিভাবে প্রবাসীদের সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
 সেবা খাতে পদক্ষেপসমূহঃ • সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে যানবাহন চলাচল এবং যানবাহনের সেবাগত মান বৃদ্ধিকরণ। • পর্যটন,বিনোদন ও প্রয়োজনীয় সেবাগুলোর মান বৃদ্ধি করতে হবে। • স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সেবা উচ্চ গুণগত মানে উন্নিত করতে হবে। • আন্তর্জাতিক রুট বৃদ্ধি উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

 কর্মসংস্থান তৈরিতে পদক্ষেপ সমূহঃ
• বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পিত মেগা প্রকল্প, অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৈরিতে দাতা রাষ্ট্রগুলোকে ইনভেস্টের আহ্বান এবং সুযোগ বৃদ্ধিকরণ। • ই-কমার্সে তরুনদের উদ্ভুদ্ধকরণ এবং সার্বিক সহায়তা প্রদান।
• অবকাঠামোগত উন্নয়ন তরান্বিতকরণ এবং নতুন কর্ম বৃদ্ধিকল্পে পরিকল্পনা প্রনয়ণ করতে হবে।
• পদ্মা সেতুর তৈরি কাজ তরান্বিত করার মাধ্যমে দক্ষিনাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং দক্ষিনাঞ্চলকে শিল্পনগর হিসেবে গড়ে তোমার পরিকল্পনা গ্রহন।
• কারিগরি প্রশিক্ষন বৃদ্ধি এবং স্বনির্ভর কর্মসংস্থান তৈরিতে সহায়তা প্রদান।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট